Prothom Alo August 24, 2015
সরল গরল
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বঙ্গবন্ধুর খুনি ‘অসওয়াল্ড’–এর প্রত্যর্পণ
মিজানুর
রহমান খান | আপডেট: ০২:০৬, আগস্ট ২৪, ২০১৫ | প্রিন্ট
সংস্করণ
বঙ্গবন্ধু
হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এ এম রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক
আশ্রয়লাভের ঘটনায় কি মার্কিন নীতিগত পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত আছে? এই প্রশ্নের
উত্তরে নিরেট হ্যাঁ বা না বলা কঠিন।
কিন্তু আমরা মনে করতে পারি যে ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত অধ্যায়ের পরে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসকে ঘিরে অনেকেই রাজনৈতিক আশ্রয়লাভের চেষ্টা করেছিলেন। ৩ নভেম্বরের সূর্যাস্তের আগে ফারুক-রশীদসহ খোন্দকার মোশতাক মার্কিন হেলিকপ্টারযোগে পালাতে চেয়েছিলেন। কিসিঞ্জার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন দরকার পড়লে তাঁরা আপাতত মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেবেন। মেজর মহিউদ্দিন আহমেদ সস্ত্রীক আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন, তিনি পাননি। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বড় নাটকটি ঘটেছিল নভেম্বরে যখন ফারুক-রশীদ ব্যাংককে মার্কিন মিশনে ধরনা দিয়েছিলেন। কিসিঞ্জারের বিবেচনার নীতি আমরা জানতে পারি। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর হয়তো তাঁকে সমর্থন দেয়নি। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেরাল্ড ফোর্ড। নিক্সন টিকে থাকলে কিসিঞ্জার যদি তাঁদের আশ্রয় দিতেন, তাহলে অবাক হতাম না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে ন্যায্য নীতি গ্রহণকারী লোকের আকাল পড়েনি। ব্যাংককে হোয়াইট হাউস, ঢাকায় বোস্টার ও দিল্লিতে স্যাক্সবি—এই তিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁদের আশ্রয় না দিতে কিসিঞ্জারকে চিঠি লিখেছিলেন। স্যাক্সবি লিখেছিলেন, তাঁদের হাতে রক্ত লেগে আছে।
তাই যুক্তরাষ্ট্র যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে ২০০৭ সালে ফেরত পাঠায়, তখন তা ছিল দৃশ্যত পঁচাত্তরের নীতির ধারাবাহিকতা। এক-এগারোতে কীভাবে এ রকম একটি আওয়ামী লীগবান্ধব সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রশাসনে আপনাআপনি গৃহীত হয়েছিল, তা-ও কম বিস্ময়কর নয়। যদি কেউ হিসাব মেলাতে চান, তাহলে বলতে পারেন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ বড় মাপে ক্ষমতায় আসছে, সুতরাং একটি সন্ধি করে রাখা হোক। ১৯৯৬ সালে প্রথম সরকার গঠন করে শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ঢাকায় আনতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ক্লিনটন ৩২ নম্বরে না গেলেও কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষায় কোনো ছন্দপতন ঘটেনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে একটা অহি-নকুল সম্পর্ক রাতারাতি কী করে এত দ্রুত ডালপালা বিস্তার করল, তা-ও এক প্রশ্ন। অনেকেই একমত এই বিষয়ে ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি রাষ্ট্রীয় নীতির ওপরে স্থান পেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এটা স্বস্তির যে এই বিষয়ে অনেক দিন ধরে একটা স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে, আর তাকে ভালো একটা অগ্রগতি হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে।
পঁচাত্তরের খুনিদের রাজনৈতিক আশ্রয় নাকচ প্রশ্নে মার্কিন সরকার পঁচাত্তরের নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে বলে ধারণা ছিল। আকস্মিকভাবে রাশেদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদানের ঘটনাটি তাই অবাক হওয়ার মতোই। ঢাকায় সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির ২০০৯ সালের তারবার্তা (উইকিলিকস সূত্রে প্রাপ্ত) অবশ্য সাক্ষ্য দিচ্ছে যে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতেই মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয়ের বোর্ড রাশেদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। তবে ওই সময় পর্যন্ত খুনিদের বিষয়ে মার্কিন নীতি ছিল—রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা-সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ না করা। নবম সার্কিটের বিচারিক সিদ্ধান্তে মহিউদ্দিনকে ফেরত পাঠানো হলো। আবার আরেক ইমিগ্রেশন বিচারকের রায়ের সূত্রে খুনি রাশেদ সস্ত্রীক আশ্রয় পেলেন।
যদিও এমনটা হতে পারে যে ২০০৭ সালে মহিউদ্দিন যে বিচার–প্রক্রিয়ায় এসেছিলেন, সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পঁচাত্তরে তাঁর প্রার্থনা নাকচ হওয়ার বিষয়টি বিবেচ্য ছিল না। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রশাসনের এটা মনে থাকার কথা। তারা কি এ-সংক্রান্ত তথ্য আদালতকে জানিয়েছিল? আমরা তা জানি না। রাশেদের বিষয়ে সিদ্ধান্তের বিস্তারিত আমরা জানি না।
এখন বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রকাশ্য বক্তৃতা-বিবৃতি এড়িয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে নীরব অথচ জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতায় শামিল হওয়া। জিএসপি সুবিধাভোগকারীদের সাম্প্রতিক তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকায় সরকারি প্রতিক্রিয়ায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ছিল। অথচ ওই সময়ে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথাই ছিল না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সরকারের বিরাগ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ন্যায্য বিষয়ে ন্যায্য কথা নিশ্চয় বলতে হবে। এবং সেটা কখন কী ভাষায় বলতে হয়, তার উদাহরণ ফিদেল কাস্ত্রো রেখেছেন। মার্কিনদের প্রতি কঠোরতা প্রকাশে বিশ্ব তাঁর মুখে কখনো ‘দুই আনার মন্ত্রী’ ধরনের অমার্জিত মন্তব্য শোনেনি।
সরকারের মিত্র হিসেবে পরিচিতরা হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করছেন। সত্যিকারের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে হিলারিকে পেলে তা হবে বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক অবিস্মরণীয় গৌরবের বিষয়। এ রকম একটি উপলক্ষের সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ পেলে আমাদের বিদেশি বন্ধুরা সন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন। সেই কূটনীতি থেকে নিজেদের অকারণে দূরে সরিয়ে রাখার পরিবেশ তৈরি করা সমীচীন হবে না।
পররাষ্ট্রনীতিতে আবেগের স্থান নেই। সীমান্তের বাইরে স্থায়ী শত্রুমিত্র হয় না, সেখানে জাতীয় স্বার্থ ছাড়া আর কিছু স্থায়ী হতে নেই, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পামারস্টোনের এই উক্তি বিশ্বনেতারা মেনে চলছেন। বাংলাদেশের মতো বিদেশনির্ভর দেশের জন্য আবেগতাড়িত নীতি আরও বেশি অনিরাপদ। প্রতীয়মান হয় যে মহিউদ্দিন ও রাশেদের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বিচারিক রায় এসেছে। এ রকম সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিভিউর সুযোগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের মানের প্রশ্নটি নবম সার্কিটের বিচারকেরা যাচাই করেছিলেন, আর তাঁদের রায় বাংলাদেশের পক্ষে এসেছিল। মার্কিন কংগ্রেসম্যান ম্যাকডারমট মহিউদ্দিনের প্রত্যাবাসন ঠেকাতে একটি বেসরকারি বিল (এইচআর ২১৮১) এনেছিলেন। কিন্তু তা বিফলে গেছে। সুতরাং আমরা দেখলাম এক-এগারোতে মার্কিন রাজনীতিকেরা আমাদের রায়ের পক্ষেই থাকলেন। উপরন্তু নবম সার্কিট কোর্ট অব আপিলস বললেন, ‘মহিউদ্দিন এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে তাঁর অনুপস্থিতিতে যে বিচার হয়েছে, তা মৌলিকভাবে অন্যায্য। এবং তাঁকে যথাযথ প্রক্রিয়ার আশ্রয় লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’ তাহলে এটা খতিয়ে দেখার বিষয় যে রাশেদ তাহলে কী প্রমাণ করেছেন। একই বিচার–প্রক্রিয়াকে বিপরীত প্রমাণ করতে পারার অর্থ দাঁড়াবে, অভিন্ন আইনি প্রশ্নে মার্কিন আদালতের রায় সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে। আসলে আমাদের জানতে হবে কী যুক্তিতে রাশেদ আশ্রয় পেলেন।
ভেতরে ভেতরে যা-ই মনে করা হোক না কেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আগে ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার নীতি সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করে চলেছেন। তখন খুব বিরল ক্ষেত্রেই প্রকাশ্য মার্কিন বৈরিতা দেখানো হয়েছিল। তা না হলে কিসিঞ্জার ঢাকা সফরে আসতেন না, তাঁর বাংলাদেশনীতি বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। কিন্তু তিনি এও জানতেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মাপের চেয়ে তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি পররাষ্ট্রনীতিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে কিসিঞ্জারের হাত আমরা নাকচ করতে অপারগ, কিন্তু দেখার বিষয় হলো পঁচাত্তরের ৬ আগস্টে বোস্টারের সঙ্গে সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু উচ্ছ্বাসের সঙ্গে নয়া মার্কিন খাদ্য সাহায্য প্রদানে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু মার্কিন জনগণ, মিডিয়া, কনসার্ট, টেড কেনেডি ও অার্চার ব্লাডের মতো লোকদের ভূমিকাকে আলাদা করেছিলেন। সেটাও এক কৌশল ছিল। মুজিব জোটনিরপেক্ষ নীতি এবং কারও প্রতি বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বকে পররাষ্ট্রনীতির মূলভিত্তি করেছিলেন, যা কালোত্তীর্ণ হয়েছে। আবেগের কারণে এ থেকে সরে যাওয়া উচিত হবে না।
কূটনীতির প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিএনপিরও উচিত হবে খুনিদের ফেরত দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানানোর। দুই দেশের মধ্যে
বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি সইয়ের প্রক্রিয়াকে তীব্র করতে হবে। বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট খুনিদের ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। বার্নিকাট এ বিষয়ে ঢাকায় তাঁর পূর্বসূরি রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিলকে অনুসরণ করার প্রকাশ্য নীতি বিবেচনা করতে পারেন।
১৯৯৬ সালে মার্কিন পলিটিক্যাল কাউন্সেলর ছিলেন স্টিফেন আইজেনব্রাউন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে তথ্য প্রকাশ করেন যে মেরিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে খুনিদের ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড কেনেডিকে ১৯৬৩ সালে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাশেদের মতোই তাঁর আততায়ী হার্ভে লি অসওয়াল্ড মার্কিন সামরিক বাহিনীর লোক ছিলেন। তাঁর বিচার হয়নি। কারণ, গ্রেপ্তারের দুই দিন পরে তিনি এক তথাকথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছিলেন। খুনের আগে হার্ভে স্বপক্ষত্যাগী হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেছিলেন।
ডেভিড মেরিল যুক্তি দিয়েছিলেন যে কেনেডির খুনি হার্ভে লি যদি পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও তো বাংলাদেশের কাছে সহযোগিতার অনুরোধ জানাত। আমরা মনে করি, সর্বোচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাশেদকে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্রদূত মেরিলের সেই যুক্তিকে আরও বেশি তীক্ষ্ণ করে তুলেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
কিন্তু আমরা মনে করতে পারি যে ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত অধ্যায়ের পরে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসকে ঘিরে অনেকেই রাজনৈতিক আশ্রয়লাভের চেষ্টা করেছিলেন। ৩ নভেম্বরের সূর্যাস্তের আগে ফারুক-রশীদসহ খোন্দকার মোশতাক মার্কিন হেলিকপ্টারযোগে পালাতে চেয়েছিলেন। কিসিঞ্জার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন দরকার পড়লে তাঁরা আপাতত মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেবেন। মেজর মহিউদ্দিন আহমেদ সস্ত্রীক আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন, তিনি পাননি। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বড় নাটকটি ঘটেছিল নভেম্বরে যখন ফারুক-রশীদ ব্যাংককে মার্কিন মিশনে ধরনা দিয়েছিলেন। কিসিঞ্জারের বিবেচনার নীতি আমরা জানতে পারি। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর হয়তো তাঁকে সমর্থন দেয়নি। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেরাল্ড ফোর্ড। নিক্সন টিকে থাকলে কিসিঞ্জার যদি তাঁদের আশ্রয় দিতেন, তাহলে অবাক হতাম না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে ন্যায্য নীতি গ্রহণকারী লোকের আকাল পড়েনি। ব্যাংককে হোয়াইট হাউস, ঢাকায় বোস্টার ও দিল্লিতে স্যাক্সবি—এই তিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁদের আশ্রয় না দিতে কিসিঞ্জারকে চিঠি লিখেছিলেন। স্যাক্সবি লিখেছিলেন, তাঁদের হাতে রক্ত লেগে আছে।
তাই যুক্তরাষ্ট্র যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে ২০০৭ সালে ফেরত পাঠায়, তখন তা ছিল দৃশ্যত পঁচাত্তরের নীতির ধারাবাহিকতা। এক-এগারোতে কীভাবে এ রকম একটি আওয়ামী লীগবান্ধব সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রশাসনে আপনাআপনি গৃহীত হয়েছিল, তা-ও কম বিস্ময়কর নয়। যদি কেউ হিসাব মেলাতে চান, তাহলে বলতে পারেন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ বড় মাপে ক্ষমতায় আসছে, সুতরাং একটি সন্ধি করে রাখা হোক। ১৯৯৬ সালে প্রথম সরকার গঠন করে শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ঢাকায় আনতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ক্লিনটন ৩২ নম্বরে না গেলেও কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষায় কোনো ছন্দপতন ঘটেনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে একটা অহি-নকুল সম্পর্ক রাতারাতি কী করে এত দ্রুত ডালপালা বিস্তার করল, তা-ও এক প্রশ্ন। অনেকেই একমত এই বিষয়ে ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি রাষ্ট্রীয় নীতির ওপরে স্থান পেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এটা স্বস্তির যে এই বিষয়ে অনেক দিন ধরে একটা স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে, আর তাকে ভালো একটা অগ্রগতি হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে।
পঁচাত্তরের খুনিদের রাজনৈতিক আশ্রয় নাকচ প্রশ্নে মার্কিন সরকার পঁচাত্তরের নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে বলে ধারণা ছিল। আকস্মিকভাবে রাশেদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদানের ঘটনাটি তাই অবাক হওয়ার মতোই। ঢাকায় সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির ২০০৯ সালের তারবার্তা (উইকিলিকস সূত্রে প্রাপ্ত) অবশ্য সাক্ষ্য দিচ্ছে যে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতেই মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয়ের বোর্ড রাশেদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। তবে ওই সময় পর্যন্ত খুনিদের বিষয়ে মার্কিন নীতি ছিল—রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা-সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ না করা। নবম সার্কিটের বিচারিক সিদ্ধান্তে মহিউদ্দিনকে ফেরত পাঠানো হলো। আবার আরেক ইমিগ্রেশন বিচারকের রায়ের সূত্রে খুনি রাশেদ সস্ত্রীক আশ্রয় পেলেন।
যদিও এমনটা হতে পারে যে ২০০৭ সালে মহিউদ্দিন যে বিচার–প্রক্রিয়ায় এসেছিলেন, সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পঁচাত্তরে তাঁর প্রার্থনা নাকচ হওয়ার বিষয়টি বিবেচ্য ছিল না। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রশাসনের এটা মনে থাকার কথা। তারা কি এ-সংক্রান্ত তথ্য আদালতকে জানিয়েছিল? আমরা তা জানি না। রাশেদের বিষয়ে সিদ্ধান্তের বিস্তারিত আমরা জানি না।
এখন বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রকাশ্য বক্তৃতা-বিবৃতি এড়িয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে নীরব অথচ জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতায় শামিল হওয়া। জিএসপি সুবিধাভোগকারীদের সাম্প্রতিক তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকায় সরকারি প্রতিক্রিয়ায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ছিল। অথচ ওই সময়ে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথাই ছিল না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সরকারের বিরাগ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ন্যায্য বিষয়ে ন্যায্য কথা নিশ্চয় বলতে হবে। এবং সেটা কখন কী ভাষায় বলতে হয়, তার উদাহরণ ফিদেল কাস্ত্রো রেখেছেন। মার্কিনদের প্রতি কঠোরতা প্রকাশে বিশ্ব তাঁর মুখে কখনো ‘দুই আনার মন্ত্রী’ ধরনের অমার্জিত মন্তব্য শোনেনি।
সরকারের মিত্র হিসেবে পরিচিতরা হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করছেন। সত্যিকারের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে হিলারিকে পেলে তা হবে বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক অবিস্মরণীয় গৌরবের বিষয়। এ রকম একটি উপলক্ষের সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ পেলে আমাদের বিদেশি বন্ধুরা সন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন। সেই কূটনীতি থেকে নিজেদের অকারণে দূরে সরিয়ে রাখার পরিবেশ তৈরি করা সমীচীন হবে না।
পররাষ্ট্রনীতিতে আবেগের স্থান নেই। সীমান্তের বাইরে স্থায়ী শত্রুমিত্র হয় না, সেখানে জাতীয় স্বার্থ ছাড়া আর কিছু স্থায়ী হতে নেই, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পামারস্টোনের এই উক্তি বিশ্বনেতারা মেনে চলছেন। বাংলাদেশের মতো বিদেশনির্ভর দেশের জন্য আবেগতাড়িত নীতি আরও বেশি অনিরাপদ। প্রতীয়মান হয় যে মহিউদ্দিন ও রাশেদের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বিচারিক রায় এসেছে। এ রকম সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিভিউর সুযোগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের মানের প্রশ্নটি নবম সার্কিটের বিচারকেরা যাচাই করেছিলেন, আর তাঁদের রায় বাংলাদেশের পক্ষে এসেছিল। মার্কিন কংগ্রেসম্যান ম্যাকডারমট মহিউদ্দিনের প্রত্যাবাসন ঠেকাতে একটি বেসরকারি বিল (এইচআর ২১৮১) এনেছিলেন। কিন্তু তা বিফলে গেছে। সুতরাং আমরা দেখলাম এক-এগারোতে মার্কিন রাজনীতিকেরা আমাদের রায়ের পক্ষেই থাকলেন। উপরন্তু নবম সার্কিট কোর্ট অব আপিলস বললেন, ‘মহিউদ্দিন এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে তাঁর অনুপস্থিতিতে যে বিচার হয়েছে, তা মৌলিকভাবে অন্যায্য। এবং তাঁকে যথাযথ প্রক্রিয়ার আশ্রয় লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’ তাহলে এটা খতিয়ে দেখার বিষয় যে রাশেদ তাহলে কী প্রমাণ করেছেন। একই বিচার–প্রক্রিয়াকে বিপরীত প্রমাণ করতে পারার অর্থ দাঁড়াবে, অভিন্ন আইনি প্রশ্নে মার্কিন আদালতের রায় সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে। আসলে আমাদের জানতে হবে কী যুক্তিতে রাশেদ আশ্রয় পেলেন।
ভেতরে ভেতরে যা-ই মনে করা হোক না কেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আগে ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার নীতি সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করে চলেছেন। তখন খুব বিরল ক্ষেত্রেই প্রকাশ্য মার্কিন বৈরিতা দেখানো হয়েছিল। তা না হলে কিসিঞ্জার ঢাকা সফরে আসতেন না, তাঁর বাংলাদেশনীতি বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। কিন্তু তিনি এও জানতেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মাপের চেয়ে তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি পররাষ্ট্রনীতিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে কিসিঞ্জারের হাত আমরা নাকচ করতে অপারগ, কিন্তু দেখার বিষয় হলো পঁচাত্তরের ৬ আগস্টে বোস্টারের সঙ্গে সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু উচ্ছ্বাসের সঙ্গে নয়া মার্কিন খাদ্য সাহায্য প্রদানে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু মার্কিন জনগণ, মিডিয়া, কনসার্ট, টেড কেনেডি ও অার্চার ব্লাডের মতো লোকদের ভূমিকাকে আলাদা করেছিলেন। সেটাও এক কৌশল ছিল। মুজিব জোটনিরপেক্ষ নীতি এবং কারও প্রতি বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বকে পররাষ্ট্রনীতির মূলভিত্তি করেছিলেন, যা কালোত্তীর্ণ হয়েছে। আবেগের কারণে এ থেকে সরে যাওয়া উচিত হবে না।
কূটনীতির প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিএনপিরও উচিত হবে খুনিদের ফেরত দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানানোর। দুই দেশের মধ্যে
বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি সইয়ের প্রক্রিয়াকে তীব্র করতে হবে। বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট খুনিদের ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। বার্নিকাট এ বিষয়ে ঢাকায় তাঁর পূর্বসূরি রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিলকে অনুসরণ করার প্রকাশ্য নীতি বিবেচনা করতে পারেন।
১৯৯৬ সালে মার্কিন পলিটিক্যাল কাউন্সেলর ছিলেন স্টিফেন আইজেনব্রাউন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে তথ্য প্রকাশ করেন যে মেরিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে খুনিদের ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড কেনেডিকে ১৯৬৩ সালে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাশেদের মতোই তাঁর আততায়ী হার্ভে লি অসওয়াল্ড মার্কিন সামরিক বাহিনীর লোক ছিলেন। তাঁর বিচার হয়নি। কারণ, গ্রেপ্তারের দুই দিন পরে তিনি এক তথাকথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছিলেন। খুনের আগে হার্ভে স্বপক্ষত্যাগী হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেছিলেন।
ডেভিড মেরিল যুক্তি দিয়েছিলেন যে কেনেডির খুনি হার্ভে লি যদি পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও তো বাংলাদেশের কাছে সহযোগিতার অনুরোধ জানাত। আমরা মনে করি, সর্বোচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাশেদকে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্রদূত মেরিলের সেই যুক্তিকে আরও বেশি তীক্ষ্ণ করে তুলেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
Prothom Alo August 27, 2015
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়দাতা দেশের সমালোচনায় কৃষিমন্ত্রী
নিজস্ব
প্রতিবেদক | আপডেট: ১৫:২৬, আগস্ট ২৭, ২০১৫
Minister Matia Chowdhury
বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের খুনিদের আশ্রয়দাতা দেশগুলোর সমালোচনা করেছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া
চৌধুরী। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত শোক দিবসের এক
আলোচনা সভায় মতিয়া চৌধুরী এ সমালোচনা করেন। শেখ রাসেল দাবা ক্লাব এই আলোচনা সভার
আয়োজন করে।
আলোচনা সভায় কৃষিমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকারী কেউ বাংলাদেশে থাকত, তাহলে তারা কি বাংলাদেশকে ছেড়ে কথা বলত?
কানাডাসহ যেসব দেশে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আছেন, সেসব দেশের জনগণ ও সরকারের উদ্দেশে প্রায় একই ধরনের প্রশ্ন রাখেন মন্ত্রী।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের জাতির জনকের হত্যাকারীদের আশ্রয়দাতা দেশগুলো লম্বা লম্বা কথা বলে। তাদের ‘মানবাধিকার’ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মন্ত্রী। খুনিদের বিচার দাবি করেন তিনি।
১৪ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একজন এ এম রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আরেক খুনি মোসলেম উদ্দিনও যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তিনি সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে পাননি। আর মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থানের কারণে নুর চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত দেবে না কানাডা। আত্মস্বীকৃত ছয় খুনির অপর তিনজন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও আবদুল মাজেদ কোথায় আছেন, তা সরকার জানে না।
আলোচনা সভায় কৃষিমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকারী কেউ বাংলাদেশে থাকত, তাহলে তারা কি বাংলাদেশকে ছেড়ে কথা বলত?
কানাডাসহ যেসব দেশে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আছেন, সেসব দেশের জনগণ ও সরকারের উদ্দেশে প্রায় একই ধরনের প্রশ্ন রাখেন মন্ত্রী।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের জাতির জনকের হত্যাকারীদের আশ্রয়দাতা দেশগুলো লম্বা লম্বা কথা বলে। তাদের ‘মানবাধিকার’ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মন্ত্রী। খুনিদের বিচার দাবি করেন তিনি।
১৪ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একজন এ এম রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আরেক খুনি মোসলেম উদ্দিনও যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তিনি সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে পাননি। আর মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থানের কারণে নুর চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত দেবে না কানাডা। আত্মস্বীকৃত ছয় খুনির অপর তিনজন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও আবদুল মাজেদ কোথায় আছেন, তা সরকার জানে না।
No comments:
Post a Comment