Anandabazar September 19, 2015
সুজয় চক্রবর্তী
১৯ সেপ্টেম্বর,
২০১৫, ১৩:০৮:৩১
পটনা শহরটা কলকাতা থেকে ঠিক কতটা দূরে, ফুল্লরার (নাম পরিবর্তিত) সে ব্যাপারে
কোনও ধারণাই ছিল না।
কাকদ্বীপের প্রত্যন্ত গ্রামের ১২ বছরের মেয়েটি কলকাতাতেই
এসেছে মেরে-কেটে এক বার। তাই পটনা শহরটা ঠিক কতটা দূরে কলকাতার, তা নিয়ে ভাবার ফুরসতই মেলেনি কখনও
ফুল্লরার।
কারণ,
সেখানে
‘ডান্স পার্টি’তে গিয়ে সে নাচ দেখিয়ে মোটা টাকা রোজগার করতে পারবে, সেই স্বপ্নেই মশগুল হয়ে ছিল মোয়েটি।
পাশের পাড়াক জনৈকা পিসি যখন এমন লোভনীয় একটা প্রস্তাব
নিয়ে হাজির হলেন, ফুল্লরা তখন নিজেই
উদ্যোগ নিয়ে তার বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ফেলেছিল।
অনেকগুলো টাকা। রঙচঙে জামা। ঝলমলে আলো। সামনে অনেকগুলো
কালো-কালো মাথা...
কিন্তু এই আলোর ঠিক পাশেই তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে
কতটা অন্ধকার, ১২ বছরের ফুল্লরার
পক্ষে তা বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। ওই সময় ফুল্লরার সঙ্গে ওদের গ্রামেরই আরেকটি মেয়ে
সরস্বতীকে (নাম পরিবর্তিত) ট্রেনে চাপিয়ে পটনায় হাজির করান ওই জনৈকা পিসি।
পটনা শহরের একটি ঘিঞ্জি গলির একেবারে শেষ মাথায় টিনের
চাল দেওয়া এক তলার একটি ঘুপচি অন্ধকার ঘরে তাদের ‘নতুন জীবন’ শুরু হয়।
দু’-তিন দিন ধরে মেয়েদের খবরাখবর না-পেয়ে ফুল্লরা ও
সরস্বতীর অভিভাবক ও পরিজনরা যখন কাকদ্বীপের স্থানীয় থানায় এসে পুলিশের দ্বারস্থ হন, তখন পুলিশ তাঁদের পাত্তাই দেয়নি। হাজারো
অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও পুলিশকে দিয়ে এফআইআর লেখানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত একটি
সর্বভারতীয় শিশু অধিকার সংস্থা ও তাদের সহযোগী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে, বেশ কয়েক দিন গড়িয়ে য়াওয়ার পর, পুলিশ এফআইআর নেয়। তদন্তে নেমে পুলিশ ওই
জনৈকা পিসির হদিশ পায়। তার বাড়ির লোকেদের চাপ দিয়ে ওই ভদ্রমহিলার পটনা শহরে
নিয়মিত যাতায়াতের কথাও পুলিশ জানতে পারে।
এর পর পটনা পুলিশের সাহায্য নিয়ে দিন কয়েকের মধ্যেই
সরস্বতী ও ফুল্লরার হদিশ মেলে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,
এক
মাসের মধ্যে ‘ডান্স পার্টি’তে তো দূরের কথা,
কোনও
দিন নাচের তালিমও দেওয়া হয়নি মেয়েদু’টিকে।
পুলিশের তদন্তে এও উঠে আসে, ফুল্লরা আর সরস্বতীর ঘটনার মাসদু’য়েক আগে
কাকদ্বীপেরই অন্য একটি গ্রাম থেকে আরও দু’টি মেয়েকে ঠিক একই ভাবে, লোভ দেখিয়ে চালান করা হয়েছিল পটনায়।
কিন্তু কোনও ভাবে ওই ঘুপচি ঘরের অন্ধকারে বন্দি জীবন থেকে সেই মেয়েদু’টি পালিয়ে
যায়। তারও বেশ কয়েক দিন পরে বিহারের মতিহারি স্টেশনে রেল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ওই
দু’জন।
ফুল্লরা,
সরস্বতী
আর বাকি দু’টি মেয়েকে পটনায় শিশু কল্যাণ সমিতির হাতে তুলে দেয় বিহারের গোয়েন্দা
পুলিশ।
এর পর আইনি জটিলতার ফাঁসে কেটে যায় আরও প্রায় এক মাস।
তার পর পটনার শিশু কল্যাণ সমিতি ফুল্লরা,
সরস্বতী
ও আরও দু’টি মেয়েকে তুলে দেয় এ রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার শিশু কল্যাণ সমিতির
হাতে। এই ভাবে প্রায় মাসতিনেকের টানাপোড়েনের পর শেষ পর্যন্ত ঘরে ফেরে ফুল্লরা ও
তার বন্ধুরা।
শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ (২০১০-২০১৪)
|
|||
|
মোট অপরাধ
(২০১০) |
মোট অপরাধ
(২০১৪) |
পাঁচ বছরে বৃদ্ধি--শতাংশে
(২০১০-২০১৪) |
পশ্চিমবঙ্গ
|
৮৮০
|
৪৯০৯
|
৪৫৭.৮%
|
বিহার
|
১৮৪৩
|
২২৫৫
|
২২.৪%
|
ঝাড়খণ্ড
|
৫৪
|
৪২৩
|
৬৮৩.৩%
|
ওড়িশা
|
১৯৪
|
২১৯৬
|
১০৩২%
|
অসম
|
১৯৭
|
১৩৮৫
|
৬০৩%
|
মণিপুর
|
৭৩
|
১৩৭
|
৮৭.৭%
|
মোট
|
২৬৬৯৪
|
৮৯৪২৩
|
৪৯৭%
|
ফুল্লরার কপাল ভালো,
সে
ও তার আরও তিন বন্ধু শেষমেশ বাড়ি ফিরতে পেরেছে। কিন্তু মায়াবী ভবিষ্যতের টানে
ফুল্লরার মতোই ভেসে যাওয়া অনেকেরই কপাল ততটা ভালো নয়!
একেবারে হালে প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’
(এনসিআরবি)-র রিপোর্ট জানাচ্ছে,
শিশু-পাচারের
ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে রয়েছে একেবারে প্রথম সারিতে। অসৎ উদ্দেশ্যে
শিশুদের, বিশেষ করে, কিশোরীদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে
যাওয়া (আইনি পরিভাষায় যাকে বলে,
‘প্রোকিওরেশন
অফ মাইনর গার্লস’)-সংক্রান্ত অপরাধের তালিকায় সারা দেশে মোট অপরাধের ৪০ শতাংশ ঘটনা
ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে।
২০১০ সালে এ রাজ্যে ‘প্রোকিওরেশন অফ মাইনর গার্লসে’র
ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়েছিল মোট ২০০টি। ২০১৪ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে গিয়ে
দাঁড়িয়েছে ৮৫২-য়। এর মানে, অন্তত, সরকারি হিসাবেই, গত পাঁচ বছরে এই ধরনের ঘটনা ৩২৬ শতাংশ
বেড়েছে। তা হলে আদত ছবিটা আরও কতটা ভয়াবহ হতে পারে,
ভাবুন!
কারণ, এই ধরনের ঘটনায় পুলিশ
যে সঙ্গে-সঙ্গেই এফআইআর নেয়,
তা
নয়। পরিস্থিতি হয়তো আগের চেয়ে কিছুটা
বদলেছে। কিন্তু সেটাও মন্দের ভালো!
আরও নজরকাড়া তথ্য হল- এনসিআরবি-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট
ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, দেশে ‘প্রোকিওরেশন অফ
মাইনর গার্লস’-সংক্রান্ত অপরাধের প্রায় ৭৫ শতাংশই ঘটেছে পূর্বাঞ্চলের চারটি রাজ্য-
পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার ও ওড়িশায়।
পুলিশের একাংশ বলছে,
এই
চারটি রাজ্য গত পাঁচ বছরে কার্যত,
পরিণত
হয়েছে ‘ট্র্যাফিকিং হাব’-এ! এনসিআরবি-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১০ থেক ২০১৪- এই গোটা সময়টা জুড়েই, শিশু-পাচার ও অপহরণের ঘটনার ক্ষেত্রে
দেশওয়ারি তালিকায় প্রথম তিনটি স্থানে রয়েছে যথাক্রমে-পশ্চিমবঙ্গ,বিহার ও অসম।
উদ্বেগের শেষটা এখানেই নয়। একটি সর্বভারতীয় শিশু অধিকার
সংস্থা সদ্য প্রকাশিত এনসিআরবি-র রিপোর্টের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, শিশু-অপহরণ সংক্রান্ত অপরাধের
(‘কিডন্যাপিং অ্যান্ড অ্যাবডাকশান’) নিরিখেও পশ্চিমবঙ্গ দেশের প্রথম পাঁচটি রাজ্যের
অন্যতম। ২০১০ থেকে ২০১৪- এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে শিশু-অপহরণের ঘটনা বেড়েছে কম করে
৬০৮ শতাংশ!
ওই সর্বভারতীয় শিশু অধিকার সংস্থার ‘পলিসি, রিসার্চ ও অ্যাডভোকেসি’ বিভাগের অধিকর্তা
কোমল গনোত্রা বলেছেন, ‘‘পূর্বাঞ্চলীয়
রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ,
বিহার
ও অসমে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা যে হারে বেড়ে চলেছে, তা যথেষ্টই উদ্বেগের। শিশুদের অপহরণ, বিক্রি ও এক জায়গা থেকে তাদের অন্য জায়গায়
নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই তিনটি রাজ্যে বেড়েছে অস্বাভাবিক ভাবে।’’
মনে রাখতে হবে,
এই
পরিসংখ্যানটাই কিন্তু শেষ কথা নয়। কারণ,
পুলিশের
খাতায় নথিভুক্ত হয়েছে, এমন ঘটনার ভিত্তিতেই এনসিআরবি-র রিপোর্টে
শতাংশ-বৃদ্ধির ওই হিসাব দেওয়া হয়েছে। আরও বহু ঘটনা ঘটছে বা ঘটেছে, যা হয় পুলিশের নজর এড়িয়ে গিয়েছে বা শেষ
পর্যন্ত এফআইআর হয়নি।
শিশুদের অন্যত্র সরানোর বৃদ্ধি-হার
(২০১০-২০১৪)
|
|||
|
২০১০
|
২০১৪
|
বৃদ্ধির হার (২০১০-২০১৪)
|
পশ্চিমবঙ্গ
|
২০০
|
৮৫২
|
৩২৬%
|
অসম
|
৭৫
|
৩০৩
|
৩০৪%
|
বিহার
|
১৫২
|
২৮০
|
৮৪.২১%
|
ওড়িশা
|
৪
|
৭৪
|
১৭৫০%
|
তবে এটাও ঠিক,
আগের
চেয়ে পুলিশের খাতায় সরকারি ভাবে এই ধরনের ঘটনা নথিভুক্ত হওয়ার ঘটনা অনেকটাই
বেড়েছে। এটা হয়েছে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে বলে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও
শিশু অধিকার সংস্থাগুলি সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে। তার ফলে, পুলিশেরও ঘুম কিছুটা ভেঙেছে!
কোমল গনোত্রার কথায়,
‘‘আমাদের
অভিজ্ঞতা বলছে, হারিয়ে যাওয়া বহু
কিশোরীর ঘটনা আমরা এখনও জানি না। কত শিশুকে যে টাকার লোভে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে
গোপনে-গোপনে, তার সঠিক খবরাখবর আমরা
এখনও পাচ্ছি না।’’
হারিয়ে যাওয়া আরও অনেক ফুল্লরা-সরস্বতীর ঘটনা সরকারি
ভাবে নথিভুক্ত হতে হবে। তাদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে হবে।
সূত্র: ন্যাশনাল ক্রাইম
রেকর্ডস ব্যুরো।
বিশ্লেষণ: চাইল্ড রাইটস্
অ্যান্ড ইউ-ক্রাই।